দৃষ্টি আকর্ষণ: বিভিন্ন ব্লগে নানা সময়ের লেখাগুলো এখানে জমা প্রক্রিয়া চলছে। কয়েকটি পাতা এখনো অসম্পূর্ণ। খুব শীঘ্রই সবকিছু সম্পন্ন হবে। ফিডব্যাক জানাতে পারেন এখানে।

৫ এপ্রিল, ২০১০

মামণিয়া

আজ পরীক্ষা ছিল। সারা বছর ফাঁকিবাজি। পরীক্ষার দু'দিন আগে তাই চোখে ঘুম নেই। তার উপর এই পরীক্ষা হল ব্যবসায় শিক্ষা সম্পর্কিত। গণিত সংশ্লিষ্ট হওয়া উচিত, গণিতের দেখা নেই, আছে কেবল মুখস্থ বিদ্যার চর্চা। যে যত মুখস্থ করতে পারবে, তারই জয়জয়কার। মুখস্থ করে গামলা ভর্তি কর, পরীক্ষা হলে গিয়ে সেটা উপুর করে ঢেলে দিয়ে আসো। গামলায় ফুটো, তো তোমার মাথায় বারি! আমারটা গামলা বলবো কিনা, তাই নিয়ে সন্দেহ, তার চেয়ে বলা ভালো চালুনি! যার সবটাই ফুঁটো! চোখ-মুখ বুজে মুখস্থ করে যাচ্ছি। দুই লাইন পড়ি, পরের লাইনে গেলে প্রথম লাইন ভুলে যাচ্ছি। একটা বিতিকিচ্ছিরি রকমের অবস্থা।

গেল সপ্তাহের মাঝে থেকে একটা সুসংবাদ পেয়ে মনটা বেশ খুশি খুশি। পৃথিবীতে নতুন অতিথি এসেছে। ফুটফুটে একটা গোলাপী নারী। আর সবাই এসেই যেমন সদম্ভে তার অস্তিত্ব জানান দেয় চিৎকার করে, সারা হাসপাতাল কাঁপিয়ে, সবাইকে হাসির কলরোলে মাতিয়ে, এ শিশু তেমন নয়। সে শুরু থেকেই চুপচাপ। মায়ের শরীরে যখন ছিল, তখনও তেমন জ্বালাতন করেনি, পৃথিবীর আলো গায়ে মেখেও সে চুপ। এক মিনিট যায়, দু' মিনিট যায়, এমনি করে বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায়। টুঁ শব্দও বের হয় না তার মুখ থেকে। সবাই একটু চিন্তিত হয়। চিকিৎসকরা আশ্বাস দেন, না, দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। বাচ্চারা মাঝে মাঝে এমন একটু আধটু করেই।
কিছু সময় পার হওয়ার পরও বাচ্চার নড়নচড়ন নেই। কেবল হৃদস্পন্দনের তালে তালে বুকের ওঠা নামা দেখা যাচ্ছে। এবার চিকিৎসকের কপালেও একটা-দু'টো করে চিন্তার ভাঁজ পরে। তারা দ্রুত ব্যবস্থা নিতে শুরু করেন। পাঁচ-দশ কিংবা বিশ মিনিটের বাচ্চার শরীর ফুঁটো করে পটাপট ঢুকে যায় কয়েকটা সুঁই। মুখ ঢেকে যায় অক্সিজেন দেবার সাহায্যকারি যন্ত্রে। গোলাপী মুখটা আর দেখা যায় না। ডাক্তাররা হুমড়ি খেয়ে পরেন তার উপর। এভাবে কেটে যায় প্রথম দিন।
পরদিন একটু উন্নতি। আলাদা করে অক্সিজেন দেবার অংশটুকু খুলে নেওয়া হয়। সাধারণ বাতাস বুকে ভরে নিতে থাকে সে। এরমাঝে একবারও চোখ খুলে রহস্যময় এই পৃথিবীকে একটুও দেখেনি। চোখ মেলে তাকিয়ে তার নীল/ কালো/ সবুজ কে জানে কেমন; চোখগুলো দেখে আত্মীয়দের খুশি করে দেবার মত করুণাও সে করেনা। একবারের জন্যে সে তার অসাধারণ সুন্দর কন্ঠস্বর শুনিয়ে কাউকে মুগ্ধ হবার সুযোগও করে দেয়না। সবাইকেই রহস্য জালে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে সে।
সবার মাঝে উৎকন্ঠা বাড়ে। চিকিৎসকের ভাষ্যমতে, বাচ্চা যদি জন্মের পর পরই না কাঁদে, তবে হয়ত সে আর দশজনের মত আমরা যাকে সুস্থ বলি, তেমন হয় না। কিছুটা অন্যরকম, আর সবার সাথে মিশতে তার হয়ত বেশ অসুবিধা হয়। পরিজনেরা, তাতেও চিন্তিত নয়, যাই হোক, যেমনই হোক, বাচ্চা বাঁচলেই হল। একটা কিছু করুন। একটা ব্যবস্থা নিন। স্বজনের আকুল আর্তি।

এমনি করে সময় কেটে যায়। সূর্য ওঠে, ডোবে। আবার ওঠে, সেটা আবার ডুবেও যায়। কিন্তু বাচ্চার মুখ রা' ফোটে না, কান্না করে না, কিংবা কিছু খাওয়াও হয় না। কেবলই স্যালাইন চলতে থাকে। তৃতীয় দিনের দিন একটু করে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা। সেটা বৃথা। বমি করে ফেলে দেয়। কেন যেন পৃথিবীর উপর তীব্র অভিমান। নীরব অভিমান। কার উপর রাগ কে জানে? হয়ত কথা বলতে পারলে, বলতে পারত। কিন্তু, সে তো কথাও বলবে না। 

গতকাল ভোরটা কি অসম্ভব সুন্দর ছিল না? কেউ দেখেছেন? মনে হয় না, প্রকৃতির বুঝি কোন বিশেষ আয়োজন ছিল? মনে হয় না, কোন বিশেষ অতিথিকে বরণ করে নেবার জন্যে এত সৌন্দর্য, এত রৌদ্রদীপ্ত সূর্যের আলোকচ্ছটা, এত মৃদুমন্দ বাতাস, এত এত পাখির কলকাকলি, কেন যেন হঠাৎ কালই কর্কশকন্ঠী কাকও চমৎকার স্বরে ডাকছিল। কে জানে? তারা হয়ত সবাই একই কাঠামোর অংশ।
আমরা যাকে আপন করে নিতে পারি নি, তাকে আপন করে নেবার জন্যেই মনে হয় এত সব সংকীর্তন। কোন নিখুঁত, কিংবা পরিপূর্ণ সৌন্দর্যকে আমাদের হাতে তুলে দেয় না প্রকৃতি। কিছু কিছু সুন্দর তার নিজের কাছেই রেখে দেয়। সেগুলোই আমরা মাঝে মাঝে দেখি আর আমাদের জীবনের সার্থকতা অনুভব করি। তেমনই সুন্দর হয়ত ঐ গোলাপী শিশুটি।

তাই তাকে আমাদের কাছে ধরে রাখা সম্ভব হয়না। ঐ শুভক্ষণে সবটুকু খুশি নিংড়ে নিয়ে অজানায় পা বাড়ায় মাত্র পাঁচদিন বয়সী অভিযাত্রী। না, না। সে একা নয়। তার সাথে ছিল যত ফুটে থাকা ফুল, পথ ধুয়ে দিয়েছিল বারিধারা, মাথায় যেন তাপ না লাগে ছায়া হয়ে ছিল মেঘমালা, আর পাখিরা তার একাকিত্ব ঘোচাতে সারা পথ গান শুনিয়েছিল।
ভালো থেকো মামণি। যেখানেই থাকো।
[মনটা খুব খারাপ ছিল কাল সারাদিন। পরীক্ষার কারণে কিছু করতে পারছিলাম না। আজ এসেই লিখে ফেললাম। :(]

1 comments:

Neel বলেছেন...

A beautiful post. Really liked your writing.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
এখানে প্রকাশিত লেখা অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও পুন:প্রকাশ করবেন না। কোন লেখা বেশি পছন্দ হলে নিজের মনে করে নিয়ে যাবার বেলায় একটু জানিয়ে যাবেন।
ব্যক্তিগত অনুভূতির সাথে একীভূত কোন লেখা অন্যত্র শেয়ার করতে পারেন।


Copyright 2009 মুক্ত বয়ান. Powered by Blogger Blogger Templates create by Deluxe Templates. WP by Masterplan modified by Mukto Boyan