দৃষ্টি আকর্ষণ: বিভিন্ন ব্লগে নানা সময়ের লেখাগুলো এখানে জমা প্রক্রিয়া চলছে। কয়েকটি পাতা এখনো অসম্পূর্ণ। খুব শীঘ্রই সবকিছু সম্পন্ন হবে। ফিডব্যাক জানাতে পারেন এখানে।

২৮ আগস্ট, ২০১০

গানগল্প- ২ [এতদিনে ফুল কুড়ালাম, ভরল মনের ডালা]

"ধূচ্ছাই, ভাল্লাগে এসব? প্রতিদিন এই একই কাজ? একখানে বসে থাকা? বসে থাকতে থাকতে তো আমি মাটির সাথেই লেপ্টে যাব! কোনদিন দেখবো, আমি নিজেই মাটিতে শিকড় গেঁড়ে ঢুকে গেছি! ধূর! আর করবো না। আজই শেষ।” আনমনে গজগজ করতে থাকে লাবণ্য। তারপর পাশের রান্নাঘরে বসে থাকা মা'কে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে থাকে, "কেন বাবা, আর কেউ নেই? আমিই কেন রোজ রোজ এই কাজ করবো? আর কেউ নেই? একটু ঘুমাতেও দেবে না, সাত সকালেই ঘুম ভাঙিয়ে দেবে! আমি মনে হয় পেটের সন্তান না। তাই এত অবহেলা। নিজের মেয়ে হলে ঠিকই ঘুমাতে দিতো।"

মেয়ের ক্রমশ: একলা কথা চালিয়ে প্রতিভায় আর কেউ মুগ্ধ না হোক, রজত বাবু অসম্ভব মুগ্ধ। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে তার প্রথম সন্তান কি হবে, সেটা নিয়ে সবার মাঝেই প্রচন্ড আগ্রহ ছিল। সেই সন্তান ছেলে হলে যেমন আদরে আদরে ঘিরে থাকতো, তার কিছু মাত্র কম পায়নি মেয়ে হয়ে লাবণ্যও। এর একটা বড় কারণ হতে পারে লাবণ্যর বড় পিসির অনুপস্থিতি, যিনি মাত্র দেড় বছর বয়সে মুখে একটি মাত্র দাঁত সম্বল করে চকিত হাসিতে সবার মায়া কেড়ে স্বার্থপরের মত সবাইকে কাঁদিয়ে নাই হয়ে যান।
মেয়ের এই অবিরত কথার তোড়ে ঘুম ভেঙে ঢুলুঢুলু চোখে বারান্দায় সূর্যপ্রণাম সেরে ঠাকুরঘরে উঁকি দেন রজত বাবু। লাবণ্য সেখানেই বসে বসে মায়ের সাথে কথা চালিয়ে যাচ্ছে। মায়ের সাথে কথা চালানো ব্যাপারটা ঠিক যুৎসই না লাগলে এটা বলা যেতে পারে, ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে যাচ্ছে। মা চুপচাপ সবজিগুলো কেটে- কুটে রাখছেন একটু পরেই রান্না চড়াবেন বলে আর লাবণ্য একা একাই কথা বলে যাচ্ছে। বাবার গলা শুনে ঘাড় আলতো বাঁকিয়ে চোখের কোণা দিয়ে তাকিয়ে দেখে। বাবাকে দেখতে পেয়েই খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে চোখ- মুখ। অসম্ভব রূপসী ষোড়শী মেয়েকে দেখে রজত বাবুর আপনাতেই কেমন যেন গর্ব হতে থাকে। এত চমৎকার মেয়ে তার। সারা দিন কথায় মুড়ে রাখে ঘরটাকে। যতক্ষণ বাসায় থাকে চারদিক যেন আলোয় ঝলমল করতে থাকে তার রূপলাবণ্যের ছোঁয়ায়। মাঝে মাঝে একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হয় রজতবাবুর বুকের বাম দিকটায়। এত প্রিয় মেয়েকে পরের ঘরে তুলে দিয়ে একা কি করে থাকবেন তিনি? ঘুমই বা  ভাঙবে কার কিচিড়- মিচিড়ে?

দিদি আবারো? রোজ রোজ চিল্লাচিল্লি না করলে তোর পেটের ভাত হজম হয় না, না? দিবো ধরে একটা থাবড়া। চুপ কর। ঘুমাতে দে। ছোট ছেলে প্রিয়াংশু'র কথা শুনে মুচকি হেসে বাস্তবে ফিরে আসেন তিনি। ভাই- বোন দু'টোতে নিত্যদিন খুনসুটি লেগেই আছে। এই প্রিয়াংশুর একটা কলম নিয়ে গেল লাবণ্য, আবার ওদিকে দিদিভাইর শখ করে কেনা নতুন ওড়না দেখে সেটাকে রাস্তার মেয়েদের পছন্দ বলে খোঁচা দেয়া ভাইটার। সারাদিন এসব চলছেই। দু'জনের হাজারটা অভিযোগ শুনতে হয় রাতে কাজ সেরে বাসায় ঢোকা মাত্রই। তবুও কখনো যদি লাবণ্য একদিনের বেশি দু'দিন বাসার বাইরে কোন আত্মীয় বাসায় থাকে, ঠিকই দ্বিতীয় দিন প্রিয়াংশুকে সেখানে নিয়ে যেতে হবে। একদিনও বোনকে ছাড়া থাকতে পারে না। ভীষণ দিদিভাই ন্যাওটা। একই রকম লাবণ্যও। ভাইয়ের অসুখে রাত জেগে শুশ্রুষা, ভোরে ঠিক ঠিক সময়ে ওষুধ খাওয়ানো থেকে শুরু করে, স্কুলের পড়া তৈরি করে দেওয়া, ঠিক যেন মায়ের পাশাপাশি ছোট মা।

কিছুটা মফস্বল মত শহর বলে এখনো বাড়ির সামনে উঠোনের চল উঠে যায়নি। এখনো বাড়ির আসে- পাশে বড় বড় ইট- কাঠ- পাথরের নিষ্প্রাণ দালানের হম্বি- তম্বি ততটা ভারি হয়ে ওঠেনি, বরং এখনো কান পাতলেই ভোরে শালিকের ডাক, মাঝ রাত্তিরে শেয়ালের হুক্কা- হুয়া কিংবা ঘরের বারান্দা লাগোয়া আমগাছকে ঘিরে লতানো গাছের দেখা পাওয়া যায় বেশ ভালোই। পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত বাড়িটাকে রাজমিস্ত্রীদের দিয়ে প্রতিবছর শুশ্রুষা করে হলেও এই বাড়ির মায়া কাটাতে পারছেন না রজতবাবু কেবলমাত্র এই চারপাশের গাছপালার কারণেই। কিছুটা ভঙ্গুর চিলেকোঠায় বসে শীতের দুপুরে আরামদায়ক উষ্ণতা উপভোগ, কিংবা বৃষ্টি হলে ছেলে- মেয়ে দু'টোর হই- হই করে সবার বারণ উপেক্ষা করে ছাদে উঠে যাওয়া, গ্রীষ্মের দাবদাহে গাছ বেয়ে উঠে আম পাড়া; এগুলোই তো এই বাসার সুবিধা, এগুলোই তো এ বাসার স্মৃতিকাতরতা। তা না হলে, কদিন ধরেই শহরে নতুন আসা "প্রতিশ্রুতি আবাসনের" প্রতি তলায় দুটি করে ফ্ল্যাট, বার তলা বিল্ডিংয়ের তিনটি ফ্ল্যাটের মালিকানা কেবলমাত্র এই জায়গার সাথে বদলের মত লোভনীয় প্রলোভনের ফাঁদ এড়িয়ে এখনো এই দ্বোতলা বাড়ির মালিকানা আঁকড়ে রাখার অন্য কোন কারণ নিতান্তই ছা-পোষা চাকুরের থাকা উচিত না।

লাবণ্যর যত অভিযোগ ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথা নিয়ে। প্রতিদিন ভোরে স্নান করে ঠাকুর পূজো দিয়ে গেরস্থালির কাজকর্ম শুরু করেন লক্ষীদেবী। ঠাকুরের পূজোতে ব্যবহারের জন্য ফুল, মালা প্রয়োজন। তাই লাবণ্যর মালা গাঁথা। আর তাই নিয়ে তার হইচই। বাড়ির সামনের উঠোনে থাকা শিউলি গাছটা যেন ফুলের ভাঁড়ার। শীত- গ্রীষ্ম বারমাসই তার ফুল ফোটানোর পালা চলে। কোন বিরাম নেই, কোন অনুযোগও নেই তার। প্রতিরাতে তার আঁচল ভরে সে ফুটিয়ে চলে স্নিগ্ধ দুধ সাদা ছোট ছোট ফুল। ছেলেবেলায় প্রথম যখন লাবণ্যর গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে শেখা, হঠাৎ হাঁটতে হাঁটতে ধপ করে পরে যাওয়ার সূচনা, তখন থেকেই কেমন করে যেন ঐ গাছের সাথে তার সখ্যতা হয়ে যায়। বলা নেই, কওয়া নেই কান্না, খাওয়ালেও কমছে না, কোলে নিয়ে হাঁটলেও কমছে না, ঘুম পাড়ানি গান শোনালেও কমছে না, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। অথচ কি আশ্চর্য, শিউলী গাছের কাছে আনতেই সব শান্ত। মন্ত্রমুগ্ধের মত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে থোকা থোকা লাল- সাদা ফুলের দিকে। আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে লাবণ্য আর সাথে হতে থাকে দুয়ে মিলে এক অপূর্ব যুগলবন্দী। প্রিয়াংশু এসে এই যুগলবন্দীতে কিছুটা ভাগ বসায়। তাতে শিউলীপ্রীতি কিছুমাত্র হ্রাস পায় না, বরং আগে যেখানে টান ছিল দ্বৈত, এখন সেটা হয়ে দাঁড়ায় ত্রয়ী।
রোজ সকালে লাবণ্যর প্রথম কাজ ফুল কুড়ানো। এটা যে তাকে দিয়ে জোর করে করানো হয়, এমনও না ব্যাপারটা, সে স্বেচ্ছায় এবং অনেক আনন্দের সাথে করে। এমন দৃশ্যও প্রতিবেশীদের কাছে খুব সাধারণ, সারারাত ঝুম বৃষ্টি, পিচ্ছিল চারপাশ, ভোরেও বৃষ্টির তীব্রতার এতটুকু হেরফের হয়নি, তার মাঝেও একটা ছোট ছেলে ছাতি হাতে দাঁড়িয়ে আর একটা মেয়ে জুল- জুল চোখে তাকিয়ে ভেজা- ভেজা ফুল তুলছে। এমন ভালোবাসা মিশে যে কাজটায়, সেটার বিরুদ্ধে অনুযোগ শোনাটা কিছুটা আশ্চর্যজনকই! প্রথম প্রথম যখন লাবণ্য ফুল কুড়িয়ে এসে পরদিন যাবে না বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতো, মা হয়ে লক্ষীদেবী তাতে আপত্তি করেননি। বরং, পরদিন নিজেই ফুল কুড়িয়ে এনে পূজো সেরেছিলেন। কিন্তু, ফুল কুড়াতে না হওয়ায় লাবণ্যর খুশি খুশি মুখ যেখানে প্রত্যাশিত ছিল, সেখানে তার অগ্নিমূর্তি দেখেই দ্বিতীয়বার আর কখনো তাকে ঘুম থেকে তুলতে ভুল হয়নি কারো। তাই তো, প্রতিদিনকার মতন আজও যখন লাবণ্য বসে বসে যাব না, যাব না করছিলো, তাতে এতটুকুও বিচলিত হননি, বরং মিটিমিটি হাসি ফুটছিল তার ঠোঁটের কোণায়।

ক'দিন ধরেই প্রিয়াংশুর বেশ জ্বর, সাথে খুক- খুক কাশিও। প্রথমে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বাভাবিক চিকিৎসা হিসেবে গায়ে চাদর জড়িয়ে সকাল বিকাল তুলসীপাতা খাওয়ানো হচ্ছিল তাকে। তাতে অবস্থার কোন উন্নতি না হওয়ায় ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া আর তার ফলাফল হিসেবে গত এক সপ্তাহ থেকে শুরু করে আগামী দশ- বারো দিন তার বিছানা থেকে ওঠা, ঠান্ডা লাগানো নিষেধ। এক রকম ঘরবন্দী অবস্থা তার। অসুস্থ ভাইটার ডাক শুনে ফুল ফেলে লাবণ্য এক ছুটে ঘরে। মশারি সরিয়ে কপালে হাত দিয়ে জ্বর মাপার প্রচেষ্টা চলে কিছুক্ষণ।
: এহ, আমার ডাক্তার আসছেন!!
ভাইয়ের খোঁচায় কিছু মনে করে না সে। অসুস্থতার কারণে সাত খুন মাফ। এরপর ফিসফিসিয়ে ভাই- বোনে চলে কিছু কথোপকথন।
: দিদিভাই, কতদিন ফুল তুলি না। ঘর থেকে বেরও হইনা। খুব ইচ্ছে ফুল তুলি। কাল আমাকে নিয়ে যাস। মা তো বের হতেই দেবে না। তুই একটু বল না..
- দেব ধরে এক থাপ্পড়! জ্বর বাঁধানোর সময় খেয়াল ছিলো না। সারাদিন টই- টই করে ঘুরে বেড়ানো, নাওয়া নেই, খাওয়া নেই ঠিক মতন। এখন ঘর থেকে বের হতে পারছি না দিদিভাই! যখন অসুস্থ আর দরকার, তখন দিদিভাই, না? দেব ধরে একটা!!

তবু, পরদিন খুব ভোরে, যখন কেউই ঠিক মত ঘুম থেকে ওঠে নি, সবে মাত্র রাতের আঁধার কেটে পূবের আকাশ চিড়ে উড়ে যাওয়া কালো কাককেও একটু লালচে মত দেখায়, তখন চুপি চুপি দরজা খুলে বের হয় দুটি ছেলেমেয়ে। যাদের একটির পরনে স্কার্ট ও গেঞ্জি আর আরেকটির পরনে যাই থাক না কেন, সেটা দেখা যাচ্ছে না গায়ে আস্ত একটি কম্বল জড়িয়ে থাকার কারণে। কম্বলের ঘেরাটোপে বন্দীর অসংলগ্ন পা ফেলা থেকেই বোঝা যায় তার দূর্বলতা; যেটা সে কাটিয়ে উঠছে পরম মমতায় তাকে ঘিরে থাকা একজোড়া বাহুর উপর ভর করে। গুটিগুটি পায়ে তারা এগিয়ে যায় শিউলি গাছটির দিকে। শিউলি তলায় আজ  শুভ্র উৎসব। সাদা সাদা ফুলে ভরে আছে পুরো অংশটুকু। আকাশ আস্তে আস্তে লাল হতে থাকে আর অনেকদিন পর প্রিয় শিউলী গাছের কাছে আসার আনন্দে বিভোর প্রিয়াংশুর কম্বল ভরে উঠতে থাকে লাল- সাদা ফুলে। উবু হয়ে দাঁড়িয়ে তার কাঁধ ধরে রাখা লাবণ্যর চোখে- মুখে তখন পরিতৃপ্তির হাসি আর মনে মনে এতদিনে ফুল কুড়ালাম, ভরল মনের ডালা


উৎসর্গ: আমার দিদিভাইকে; আমার সাথে রক্তের কোন সম্পর্ক নেই, তবু আমার প্রতি যার অসম্ভব রকমের বেশি স্নেহাশীষ।
উপহার: সদা হাসিমুখ একজনকে; যার জন্মদিন ৫ই আগস্ট, আমার আগের গল্পের মূলচরিত্রের ঐ তারিখেই ঘটা দূর্ঘটনা যাকে দু:খ দেয়। 
কৃতজ্ঞতা: তিথীডোরকে; যে ফেসবুকে গানটা শেয়ার না করলে এই গল্প হয়ত লেখাই হত না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
এখানে প্রকাশিত লেখা অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও পুন:প্রকাশ করবেন না। কোন লেখা বেশি পছন্দ হলে নিজের মনে করে নিয়ে যাবার বেলায় একটু জানিয়ে যাবেন।
ব্যক্তিগত অনুভূতির সাথে একীভূত কোন লেখা অন্যত্র শেয়ার করতে পারেন।


Copyright 2009 মুক্ত বয়ান. Powered by Blogger Blogger Templates create by Deluxe Templates. WP by Masterplan modified by Mukto Boyan