ছোট ছোট টিনের ছাউনি দেওয়া খুপরি মতন অনেকগুলো ঘর। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের শখের নাম 'ডর্মেটরি'। এখানে শখ নেই, এখানে স্থুল বাস্তবতা। কয়েকটি ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, বাকিগুলোর সামনে বেশ কয়েকজন নারী। কারো বয়সই ৩০-এর বেশি হবে না। কয়েকটি ১২- ১৪ বছরের বালিকাকেও দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকের শরীরে কেমন যেন একটা হেরে যাওয়া মানুষের প্রতিচ্ছবি। সবারই মুখে প্রচুর পরিমাণ পাউডার দিয়ে সাদা হওয়ার চেষ্টা, আর ঠোঁটে লাল লিপস্টিক-এর ছোঁয়া। কয়েকজনের মুখে আবার কিছুটা লেপ্টানো। বাইরে বাজার।
হই-হট্টোগোল। ভেতরে এর রেশমাত্র নেই। রয়েছে শুধু কোন একজনের আসার অপেক্ষা। আর কেউ এলেই তাকে নিয়ে টানা-হেঁচড়া। এ যে রুটি-রুজির প্রশ্ন। তাই সবাই শকুনের মত তক্কে তক্কে থাকে কোন একজনের আসার জন্যে। কেউ এলেই হল। তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি। হোক সে ৫০ বছরের বৃদ্ধ, ২৫ বছরের যুবা কিংবা ১৮ বছরের সদ্য কৈশোরউত্তীর্ণ কেউ। সবাই এখানে সমান। সবাই এখানে খরিদ্দার।
হঠাৎ মূল গেইট খোলার শব্দ শোনা যায়। একে অপরের দিকে আড়চোখে দেখে সবাই। দুইটি ছায়া এগিয়ে আসতে থাকে। কাছে আসার পর একজনকে চেনা যায়। ৩৫ বছর মত হবে। বাধা। প্রায়ই আসেন। এমনভাবে এগিয়ে আসতে থাকেন, পুরো পাড়া-ই তার নিজের হাতের তালুর মতই চেনা। তাকে দেখে একজনের মুখে ঈষৎ হাসি ফোটে। নীরবে ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দেয় সে। লোকটি-ও তার পিছু পিছু ঘরে ঢোকে।
ভেতরে কিছুক্ষণ হাসির আওয়াজ, কিছুটা হুটোপুটির শব্দ পাওয়া যায়। তারপর কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর...
পেছনের কথা:
বিকেল প্রায় ৪ টা। নিজাম সাহেব আজ খুব ব্যস্ত। সারাদিন আজ মিছিল, মিটিং, সেমিনার। 'বিশ্ব এইডস দিবস'-এর জন্যে আজ সারা শহর সাজানো হয়েছে। সর্বত্র একটি লেখা, 'বাঁচতে হলে, জানতে হবে'। এই স্লোগানকে সামনে রেখে আজ নানা অনুষ্ঠান। এগুলোর কয়েকটায় তিনি প্রধান অতিথি। "আমাদের আসলে সবার সাথে এ বিষয়গুলো নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করা উচিত। এগুলো আসলে লুকোনোর বিষয় নয়। আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তার জন্যে এইডস নিয়ে তাদের সাথে কথা বলতে হবে। তাদেরকে বিজ্ঞানমনস্ক ব্যাখ্যা দিতে হবে। তা না হলে এ যুবসমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। আর এক্ষেত্রে আমাদের সেলুন ও পতিতাপল্লীগুলোতে স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।"
হাততালি আর থামেই না। খুব প্রসংশা পান নিজাম সাহেব তার স্পষ্ট বক্তব্যের জন্যে।
বক্তব্য শেষ করেই তিনি বেরিয়ে পড়েন। একাই রিকশা নেন। বাজারের একটু দূরে নেমে একটা পান কিনে হাঁটতে থাকেন কিছুটা উদ্দেশ্যহীনভাবেই। এরপর হঠাৎ যেন কিছু একটা মনে পড়েছে এমন ভাব করে ঢুকে পড়েন ভেতরে।
ভেতর থেকে নারীকন্ঠের আওয়াজ ভেসে আসে, "এটা ছাড়া আমি আপনার সাথে নাই। কাইল এক আপায় আইছে, উনি কইছে। নিরাপদ থাকতে হলে আর সুস্থ থাকতে হলে এর কোন বিকল্প নাই।"
রেগে ওঠেন তিনি, "কী?? তুই আমারে বিশ্বাস করস না?? আমার অসুখ??"
"আমি কী তা বলছি?? সবাই কয়, আমি শুনছি। আপনি অসুস্থ। তাই আপনি এখানে, আমার কাছে আসেন। আমি আর আপনার সাথে নাই।"
"তোর.. তোর.. মুখ আমি ভাইঙ্গা দিব। আর কে আসছিল কাল?? কোন এনজিও থেইকা আসছিল ক.." মুখ দিয়ে আর কথা বেরুচ্ছিল না নাজিম সাহেবের। শুধু গালি-গালাজ করে যাচ্ছিলেন। একটা সময় আর কথাই বলতে পারলেন না। হাঁপানী উঠে ওখানেই বসে কোঁকাতে থাকলেন।
করুণার চোখে তার দিকে চেয়ে থাকলো মেয়েটি। পান খেয়ে লাল করা ঠোঁট থেকে ফিক করে পানের পিক ফেলে আর এক দিকে চেয়ে থাকল সে।
একটু পর, হয়ত বেশ কিছুক্ষণ পরই হবে। একটি মেয়েকে বের হতে দেখা যায় পাড়া থেকে। পরদিন পাশের নদীর ঘাটে একটি মেয়ের লাশ ভেসে থাকতে দেখা যায়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছিল। তাই কে বেরিয়েছিল তা আর বোঝা যায়নি।
হয়ত ঐ মেয়েটিই হবে। অথবা হবে নাজিম সাহেবের মত কিছু মানুষের প্রতারণার শিকার হওয়া সমাজের অচ্ছ্যুৎ কোন মেয়ে।
প্রথম প্রকাশ: ৪-১-'০৯ ইং
http://www.somewhereinblog.net/blog/muktoBoyan/28893048
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন