দৃষ্টি আকর্ষণ: বিভিন্ন ব্লগে নানা সময়ের লেখাগুলো এখানে জমা প্রক্রিয়া চলছে। কয়েকটি পাতা এখনো অসম্পূর্ণ। খুব শীঘ্রই সবকিছু সম্পন্ন হবে। ফিডব্যাক জানাতে পারেন এখানে।

৩১ মার্চ, ২০১০

আনন্দযজ্ঞ মঙ্গলালোকে

রাত- ২.৩০ টা।
দূরে কোথাও রেডিও-তে গান বাজছে। “ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু.............”
মেজাজ এমনিই খারাপ। তার উপর আবার গান, খালি ভালোবাসা-বাসি। বন্ধুত্ব নাই। কেবল-ই প্রেম!
শাওনের মেজাজ আরো খারাপ হতে থাকে। প্রাইভেট হাসপাতাল। চারদিকে সুনসান নীরবতা। শুধু দূরে কোথাও থেকে গান ভেসে আসছে। বিকেল থেকে ছুটোছুটি। ভাইয়া প্রাইভেট প্র্যাকটিসে চট্টগ্রাম। ভাবির ব্যাথা উঠেছে। বাসায় কেউ নেই। বাড়ির দারোয়ানটা-ও ঈদের ছুটি নিয়ে গ্রামে। একলা বাসায় ভাবিকে নিয়ে বিপদেই পড়া গেল। ভাইয়ার ফোন এনগেজ্‌ড। মনে মনে এক প্রস্থ গালি দেয় শাওন। মুখে শুধু বলে “শালা! এমন অবস্থায় কেউ বউকে একলা ফেলে রেখে যায়! শুধু টাকা!”

ভাবির ফর্সা মুখ লাল হয়ে উঠেছে কষ্টে। প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে। তবুও স্বামীর পক্ষ নেয় নাবিলা। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে, “শাওন, তুমি তো বুঝ। ডাক্তার মানুষ। তুমি আবার একটা ফোন কর না?”
পঞ্চম বারের বার ভাইয়াকে ফোনে পাওয়া যায়। ততক্ষণে বাসায় তালা দিয়ে শাওন ভাবিকে নিয়ে পি.জি.-এর দিকে গাড়িতে।
নাবিলার স্বামী ডা: মাসুম। কার্ডিওলজির নামকরা চিকিৎসক। সারাদিন ব্যস্ত। এখানে সেমিনার, ওখানে মিটিং। আর হাসপাতাল, প্রাইভেট প্র্যাকটিস তো আছেই। সব শুনে সাথে সাথে বলেন,“পি.জি. না, স্কয়ার!!” গাড়ি ঘুরিয়ে সায়েন্স ল্যাবের দিকে রওনা দেয়।
আরো অনেক কথা বলতে থাকে মাসুম। আব্বা-আম্মাকে বলবে, আপুকে আসতে বলবে.... কোন কথা কানে ঢোকে না শাওনের। শুধু একটাই চিন্তা মাথায় এলোমেলো উকি দিয়ে যায়। তাই হু হু করে যেতে থাকে ভাইয়ার কথায়। তার মাঝে একবার শুধু বলে, “হাসপাতালে যেন বলে দেয়, ওরা আসছে।”
ঈদের ছুটির বিরক্তিকর দিনগুলো এই প্রথমবারের মত ভালো লাগে শাওনের। সায়েন্স ল্যাবের মোড়ে কোন জ্যাম নেই। পনের মিনিটের মাথায় স্কয়ার। আধঘন্টার মাথায় ভাবি ও.টি.তে। এক ঘন্টার মধ্যে আব্বা-আম্মা-আপু-দুলাভাই হাসপাতালে।

কেবিনের দরজা খুলে আপু বের হয়ে আসেন। শাওনের দিকে তাকিয়ে মাথার এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, “আজ অনেক ছোটাছুটি করেছিস সারাদিন। এখন ঘুমুতে যা।” শাওনের সারা শরীর ভেঙে পড়ে। মেজাজ খারাপ ভাবটা কখন যে মন খারাপ হয়ে কান্নায় পরিণত হয়েছে, নিজেই জানে না। আপুকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর কাঁদতে থাকে সে।


ছয় বছর আগের কথা।
- শাওন শোন। আজ ভার্সিটি থেকে আসার সময় ডা: জামিলের কাছ থেকে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে এসো তো ভাই।
: এখন-ও জ্বর কমেনি, না?
- উহু। আজ পাঁচদিন হয়ে যাচ্ছে। জ্বর কমার কোন লক্ষণ-ই নেই।
মাসুম- নাবিলার প্রথম সন্তান স্মিতা। পরিবারের একমাত্র বাচ্চা মুখ। সবার আদরের।আর মেয়েও হয়েছে এমন, যেন সব সৌন্দর্যের আধার। সবসময় হাসিমুখ। শাওন নাম দিয়েছে “হাসিকন্যা”। মাসুম স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরে। রোজ ফোন করে মেয়ের সাথে কথা বলা চাই-ই চাই।
পরদিন স্মিতাকে নিয়ে জামিলের চেম্বারের আসে শাওন। জামিল মাসুমের ছোটবেলার বন্ধু। মাসুমদের পরিবারেরই একজন হয়ে গেছে এখন সে।
- জ্বর কয়দিন?
: এই তো ১ সপ্তাহ। ক’দিন আগে ভাবির সাথে গ্রামের বাড়ি যায়। সেখান থেকে ফিরেই তো জ্বরে পড়ল।
- হুম ।
: ভয়ংকর জ্বর। ১০৫- ১০৬। ১- ২ দিন থাকে। তারপর একদিন হয়তো ঠিক থাকে। আর পরদিন আবার এমন জ্বর।
- কিছু ঔষুধ লিখে দিচ্ছি। এগুলো খাওয়াও আর ১ সপ্তাহ পর দেখা কর।

ঔষধ খুঁজতে গিয়ে শাওন হতভম্ব। একটা ঔষধ-ও পাওয়া যাচ্ছেনা। সব নতুন এসেছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তিনটা পায়। একটা খুঁজে-ই পায় না। আবার ডাক্তারের সাথে কথা বলে ঔষধ বদলিয়ে নেয় সে। বাসায় এসে টিভি দেখতে বসে।
“ভেজাল ঔষুধে বাজার সয়লাব। মানুষের ব্যবহৃত ঔষধে মেশানো হচ্ছে ভেজাল। অধিক লাভের আশায় বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো নিম্নমানের উপাদান মিশিয়ে তৈরি করছে জীবনরক্ষাকারী গুরুত্বপূর্ণ সব ঔষধ। কিছু অসাধু ডাক্তারদের যোগসাজশে তারা নতুন নতুন এসব ঔষধ বাজারজাত করছে, আর মানুষদের ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুমুখে। আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি ......”
- দেখেছ ভাবি, কি অবস্থ? মানুষকে তো মেরে ফেলবে এরা।
: হুম। অসুখে যতটুকু মরবে, সুস্থ হতে গিয়ে তো তার চেয়েও বেশি মারা যাবে।
আর কথা এগোয় না। নিঃশব্দে ভাত খেয়ে উঠে যায় শাওন। পরশু থেকে পরীক্ষা। ভীষণ চাপ। এক সপ্তাহ কখন যে পার হয়ে যায় মনে-ও থাকে না। কিন্তু, স্মিতার জ্বর কমছেই না। সাথে যুক্ত হয়েছে কাশি আর বুকে ব্যাথা।

মা-মেয়েতে মিলে জামিলের কাছে যায় নাবিলা। সব শুনে কিছু টেস্ট দেয় জামিল।
তখনই চেম্বার থেকে বের হয়ে সবগুলো টেস্ট করায় সে। সারাদিন ছোটাছুটি। অসুস্থ শরীরে সহ্য হয় না স্মিতার। সিএনজিতে আসার পথে নাবিলার কোলে ঢলে পড়ে সে।
বাসায় এসে প্রচন্ড কাশি। থামছেই না। সাথে শ্বাসকষ্ট।
কাশতে কাশতে প্রথমবারের মত রক্তবমি করে স্মিতা।

স্মিতাকে নিয়ে শুরু হয় ছুটোছুটি। দ্রুত ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যায় তাকে শাওন। অনেক ঘোরাঘুরির পরও একটা কেবিনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়না। শেষে জামিলের পরিচয় দিয়ে একটা সিটের ব্যবস্থা হয়। সাধারণ বেড। এত খারাপ অবস্থা। তার উপর কোন ডাক্তারের দেখা নেই। নার্স এসে নাবিলাকে সান্ত্বনা দিয়ে কিছুটা সুস্থির হতে বলে আর স্মিতাকে একটা স্যালাইন লাগিয়ে দেয় ।

এরপরের ঘটনাগুলো দ্রুত ঘটতে থাকে। টেস্টের রিপোর্ট হাতে আসে। রিপোর্ট নিয়ে জামিলের কাছে নিজেই যায় নাবিলা। সব দেখে কিছুক্ষণ থমকে যায় জামিল।
: ভাবি, এই টেস্টটা আপনি আবার করান।
- কেন? কি হয়েছে? কি হয়েছে আমার মেয়ের?
: না, তেমন কিছু না। তবুও একটু সিওর হওয়ার জন্য আপনাকে আবার টেস্ট করাতে বললাম।
- খারাপ কিছু হয়নি তো?
: না না, কি যে বলেন? আপনি শান্ত হন। আর টেস্টটা করান। আমি মাসুমের সাথে কথা বলি। কিছু ঔষধ পাল্টে দেয় জামিল।

দুই দিন কেটে যায়। স্মিতার অবস্থার ক্রমশ অবনতি হতে থাকে। মাসুমকে ফোন করে দেশে আসতে বলে নাবিলা। মাসুমের অসহায় আত্মসমর্পণ, ‘সবকিছু গুছিয়ে আসতে অন্ততঃ ১০-১২ দিন।’ চারিদিকে অন্ধকার দেখে নাবিলা। এমন অবস্থায় পড়ালেখা লাটে ওঠে শাওনের-ও। বাড়িতে খবর দেওয়া হয়। আম্মাকে আসতে বলে সে।
জামিলকে ফোন করে মাসুম।
- কিরে, কি হয়েছে স্মিতার?
: ভাবির সাথে কথা হয়েছে তোর?
- হুম্। বলল তোর সাথে কথা বলতে, কি হয়েছে?
: এখানে তো অত ভালো ব্যবস্থা নেই। তা-ও যা বুঝছি, মনে হয় হার্ট-এ সমস্যা।
- কি হয়েছে?
: ওর হার্টে কয়েকটা ছিদ্র ধরা পড়েছে।
- কী?
মাসুম আর কথা বলতে পারে না। সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে।
: তুই দেশে আসিস না। আমি এখানে সব ব্যবস্থা করছি। তুই ওখানে হাসপাতালের সাথে কথা বল।

পরদিন জামিল নিজেই যায় হাসপাতালে। অবস্থার কোন উন্নতি নেই। ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে মেয়েটা। ভাবি আর শাওনকে অবস্থাটা বুঝিয়ে বলে জামিল।
শাওনের ব্যস্ততা বাড়ে। পাসপোর্ট, ভিসা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। এর মাঝে একদিন শাওন বাড়ি যায়। আব্বার সাথে কথা বলে টাকার ব্যাপারে। বিশাল অঙ্ক। তখন-ও আপার বিয়ে হয়নি। আপার বিয়ের জন্য রাখা টাকা, শাওনের নিজের টাকা, মাসুম- নাবিলার টাকা, কিছু ধার-দেনা করেও সবটা জোগাড় হয় না। “যেভাবে পারো, টাকার ব্যবস্থা করো”, বলে ঢাকায় রওনা দেয় শাওন।
হাসপাতালই তখন নাবিলা ঘর-বাড়ি। তাই শাওন সরাসরি সেখানেই চলে আসে। বারান্দায় ভাবির সাথে দেখা হয়ে যায়। ভাবির মুখ দেখেই সে বুঝতে পারে, কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। তবুও সে বলতে থাকে,
: টাকার ব্যবস্থা প্রায় হয়ে গেছে। কালকের মধ্যেই কাগজপত্র সব এসে যাবে। জামিল ভাইয়াকে খবর দিব। এসে ডাক্তারদের সাথে কথা বলবেন।
: যাই, ভাইয়াকে ফোন করে আসি। দেখি ওখানে কি অবস্থা?
শাওন উঠতে যায়। হাত ধরে টেনে ধরেন ভাবি।
- আমি ফোন করেছি তোমার ভাইয়াকে। ও আসছে।
: মানে?
- তুমি অনেক কষ্ট করেছ। আর একটু কষ্ট করবে?
অবাক হয়ে ভাবির দিকে তাকায় শাওন। শূন্য দৃষ্টি। দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই।
- একটা ট্যাক্সি ডাকো। আমি আমার মা-মণির সাথে এক অ্যাম্বুলেন্সে বাসায় ফিরতে পারবো না।


হঠাৎ কেবিনের ভেতর থেকে বাচ্চার কান্নার শব্দ ভেসে আসে। উঁকি দিয়ে দেখে শাওন। রুম ভর্তি উৎসুক মানুষের ভীড়। আব্বা-আম্মা-দুলাভাই-ভাইয়া, ভাবির আত্মীয়- স্বজন আর রুদ্র অথচ শান্ত ভঙ্গিতে বাবুকে বুকে জড়িয়ে ভাবি। যেন এবার আর কিছুই বাবুকে ছুঁতে না পারে। এ যখন বড় হবে, তখন হয়ত জানতে পারবে, তার বড় বোন টাকার অভাবে আর সঠিক চিকিৎসার অভাবে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। সকলের অগোচরে। একা আর অসহায়। ভুল চিকিৎসায়। আর এখন! এ হাসপাতাল না ও হাসপাতাল। আপুর দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে শাওন। আঁচল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দেন আপু। “ধূর বোকা! ওসব নিয়ে এখন ভাবতে আছে? নতুন বাবু। ওর জন্য দোয়া কর।”

দূরে কোথাও, হয়ত রেডিওতেই বাজতে থাকে,
‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে,
বিরাজ সত্য সুন্দর।’

প্রথম প্রকাশ: ৭-১-'০৯ ইং
http://www.somewhereinblog.net/blog/muktoBoyan/28894055
http://www.somewhereinblog.net/blog/muktoBoyan/28894569

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
এখানে প্রকাশিত লেখা অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও পুন:প্রকাশ করবেন না। কোন লেখা বেশি পছন্দ হলে নিজের মনে করে নিয়ে যাবার বেলায় একটু জানিয়ে যাবেন।
ব্যক্তিগত অনুভূতির সাথে একীভূত কোন লেখা অন্যত্র শেয়ার করতে পারেন।


Copyright 2009 মুক্ত বয়ান. Powered by Blogger Blogger Templates create by Deluxe Templates. WP by Masterplan modified by Mukto Boyan