আমাদের এই নসিমন আর নষ্ট হয়না। আমরা একবারেই কুষ্টিয়া পৌঁছে যাই। আসার পথে আমরা বিষাদসিন্ধু খ্যাত মীর মোশাররফ হোসেনের বসতভিটা দেখতে পাই। কিন্তু, ততক্ষণে আমাদের পেটের ভেতর ছুঁচো বুকডন করা শুরু করেছে!!



ভাত খেয়ে কিছুটা স্বস্তি!! এরপর আমরা মাজারে না ঢুকে বাইরে দোকানে ঘুরতে থাকি। একতারা, দোতারা, বাঁশি, ঢোল, খঞ্জণীর সম্ভার!! আমরা তো এগুলো বাজাতে পারি না। তাই আর কী কিনি?? হাতে পরা যায় এমন কিছু সামগ্রী কিনলাম, যেগুলো ঢাকায় চারুকলার সামনে কিনতে পাওয়া যায় ১০-১৫ /- য়। কিন্তু কুষ্টিয়া বলে কথা। সবগুলোর দামই ২৫-৩০/-র উপরে। তাও শখ!! কিনেই ফেললাম!!

এবার মাজারে ঢুকলাম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, সারাদিন ঘোরা-ঘুরি করে বিকেলে মাজারে বাউলদের গান শুনে রাতে মাজারেই থেকে যাব। সকালে উঠে বাস/ ট্রেন। কিন্তু সে পরিকল্পনা আর পূরণ হয়নি। সে কথা যথাস্থানে!!
মাজারের ভেতর অসাধারণ সুন্দর। ঢুকতেই মূল মাজার যেটি, সেটি একটি মসজিদের মত কক্ষে। গম্বুজাকৃতি। এটি ঘিরে ছোট একটি বাগান। বাগানের উপর দিয়ে একটু পায়েচলা পথ। এটি দিয়ে হেঁটে ঢুকতে হয় মাজারে। মাজারের বাইরে আরও সাতজন বাউলের কবর। মাজারের সামনেই যথারীতি এক বাউলমত লোক, সামনে একটি দানবাক্স!!


যাই হোক, আমরা সেখান থেকে এগিয়ে গেলাম আমাদের মূল লক্ষ্যের দিকে। বাউলরা যেখানে গান করেন, সেই স্থানের দিকে। বাউলরা আসলে সর্বত্রই গান করেন। তাও, একটি চারদিক খোলা হলঘরের মত জায়গা আছে। তারা সবাই সেখানেই গান করেন। এরপাশেই একটি চারতলা ভবন। এটিই মূল ভবন। এটিই লালন একাডেমি!! এখানে নিচতলায় অফিস। আর লালন জাদুঘর। তবে এটি বন্ধ থাকায় ভেতরে দেখতে পারিনি।


আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম, অনেক বাউল একসাথে গান করবেন, আমরা কিছুক্ষণ এ'নার, কিছুক্ষণ ও'নার গান শুনব। কিন্তু ব্যাপার এমন না। একটি কাপড় পাতা আছে। কয়েকজন লোক আসলে বাউলদের সাথে কথা হয়। টাকা পাবেন, এমন প্রতিশ্রুতি পেলেই কেবল মাত্র তারা গান শুরু করেন!! তাদের সাথে তবলাবাদক, হারমোনিয়াম বাদক, জুরি বাদক সবার যোগাযোগ করা থাকে। বাউল বসলেই সাথে সাথে সবাই চলে আসেন!!

আমরা ঢোকার পর কোন গান হচ্ছিল না। একটু পর, কিছু মানুষ এসে গান শুনতে চাওয়ায়, গান শুরু হয়। আমরাও সুযোগ পেয়ে তাদের পাশে বসে পড়ি!!

দু'টি গান হওয়ার পর মানুষগুলো কিছু টাকা দিয়ে চলে যান। আমরা তখন আমাদের অনুরোধের ঝাঁপি খুলে বসি!! এটা শোনান, ওটা শোনান। তারা তাদের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান করতে থাকেন। আমাদের একজন গিটার বাজায় তাদের সাথে। আর আমরা যারা কিছুই পারিনা, তারা কেবল মাথা ঝোঁকাতে থাকি!! এভাবে চলতে থাকে অনেকক্ষণ। আমরা ভাগ্যবান। যিনি তখন গান করছিলেন, তিনি খুবই ভাল একজন মানুষ। আমাদের সব অনুরোধই তিনি রেখেছিলেন। প্রায় ৫টা পর্যন্ত গান শুনিয়ে তিনি দুপুরের ভাত খাওয়ার বিরতি নিয়ে গান থামান। সাথে সাথে আমাদের তার বাসায় আমন্ত্রণ জানাতে ভোলেননি।

আমদেরও তখন খাওয়ার কথা মনে পড়ে। আমরা উঠে পরি। আমাদের দেখে অনেকেই এগিয়ে আসেন। তাদের সাথে এই লালনকে নিয়ে, তার গান নিয়ে কথা হয়। বাউলদের মাঝে বিভেদ দেখে আমরা অবাক হয়ে যাই। এক বাউল আরেক বাউলের গান অশুদ্ধ বলে দাবি করে!! আমরা চুপ করে শুনে যাই। তাদের কথা-বার্তা নিয়ে আরেকদিন লিখব।
কিছু পরে হঠাৎ মনে হয়, সকালে আসার পথে দেখা একটি মন্দিরের কথা। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হয়, গান তো শোনা হল, এখন মন্দির দেখা হবে। রওয়ানা হলাম মন্দির দর্শনে।
মন্দিরের নাম রঘুনাথ জিউ'র মন্দির। ইতিমধ্যে আমি জিলা স্কুলের এক পিচ্চিকে ফোন করে আসতে বলেছি। মন্দিরটি খুবই সুন্দর। একই সাথে শিব ঠাকুর, দূর্গা পূজো, কালী মা, রাধা-কৃষ্ণ সবই একই সাথে পাশাপাশি।
সেখানে এসেই আমাদের চিন্তা হয়, সবই তো মোটামুটি দেখা হয়ে গেছে শুধু-শুধু আর একটি দিন থেকে লাভ কি?? অনেক তর্ক-বিতর্কের পর পরদিন থাকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। আরও সিদ্ধান্ত হয়, পরদিন আমরা মুজিবনগর বৈদ্যনাথতলা'য় যাব।
আর রাতে মাজারে থাকা যাবে না। রাত ১০ টার পর মাজারের মূল গেইট বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন আমাদের মনে পড়ল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষকের কথা। তিনি একটি হোটেলের কথা বলেছিলেন, সেখানে গিয়ে তার কথা বললে থাকার কোন অসুবিধা হবেনা। সাথে সাথে ঐ হোটেলে ফোন করে রাতে থাকার জায়গা কনফার্ম!!
তবে আপাতত.. খাওয়া!!

আবারও কয়েকটি ছবি। যথারীতি সাকিব-এর!!
মূল প্রবেশপথ:
মাজার:
৭ বাউলের কবর:
বামে একাডেমিক ভবন ও ডানে গানের স্থান:
চলছে গান গাওয়া:
বাউল:
জুড়ি, হারমোনিয়াম:
একতারা, ঝুনঝুনি:
খঞ্জণী:
গেল বারের লালন উৎসবের পোস্টার:
মাজারের বাইরে বিক্রিত বিভিন্ন সামগ্রী:
পরবর্তী পর্ব
প্রথম প্রকাশ: ৭-৩-'০৯ ইং
http://www.somewhereinblog.net/blog/muktoBoyan/28921100
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন